স্বদেশ ডেস্ক:
করোনা ভাইরাস মহামারী এখনো পিছু ছাড়ছে না মানুষের। ভাইরাসটির একের পর এক নতুন ধরন ক্রমান্বয়ে মানুসের স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত করছে। সম্প্রতি ভাইরাসটির নতুন ধরন ওমিক্রন সারা বিশ্বে জেঁকে বসেছে। এরই মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ওমিক্রনকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ ঘোষণা করেছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এরই মধ্যে ওমিক্রন সংক্রমণ মোকাবিলায় বিভিন্ন প্রস্তুতি নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশ সরকারও এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এরই মধ্যে রোগীর চাপ বাড়লে তা মোকাবিলায় দেশের হাসপাতালগুলো প্রস্তুতি নিয়েছে। বিশেষ সাবধনতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক বন্দরগুলোকে। দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিয়ষযটি মাথায় রেখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ২৩ দফা নির্দেশনা প্রস্তাব করা হলেও মন্ত্রণালয় ১৫ দফা নির্দেশনা জারি করেছে। এমনকি মাস্ক ছাড়া চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণে সরকারের উচিত দ্রুত সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া। বিমানবন্দরে এবং অন্যান্য বন্দরগুলোতে র্যাপিড পিসিআর মেশিন বসানো উচিত। যদিও বিদেশ থেকে আসা নাগরিকদের অ্যান্টিজেন পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা
হয়েছে। তার পরও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এবং যক্তরাষ্ট্র থেকে যারা আসছেন তাদের বিমানবন্দরে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া পর্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও প্রতিদিন বিপুল মানুষ দেশে প্রবেশ করছে। তাদেরও পরীক্ষার আওতায় আনা জরুরি। এ ক্ষেত্রে বন্দরগুলোতে র্যাপিড পিসিআর মেশিন বসাতে হবে। পরীক্ষায় যারা কোভিড-১৯ পজিটিভ হবেন তাদের রাখতে হবে কোয়ারেন্টিনে। তা ছাড়া মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে ওমিক্রন আক্রান্ত শনাক্ত হলেও এখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত। অনেক দেশে শনাক্ত বাড়লেও লক্ষণ ও মৃত্যু বাড়েনি। ডেল্টার ক্ষেত্রে চিত্র ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ ছাড়া টিকা নেওয়া থাকায়, সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যুতে তেমন কোনো প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে এটা এখনো দুশ্চিন্তার কারণ না হলেও সব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। ওমিক্রনের সংক্রমণশীলতা থেকে রক্ষা পেতে আরও গুরুত্ব দিতে হবে টিকার বুস্টার ডোজের ওপর।
জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জার (জিআইএসএআইডি) ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১০ জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। তবে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনা সংক্রমণের হার এক শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আগের দিন সকাল ৮টা থেকে গতকাল বুধবার একই সময় পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছে আরও ৮৯২ জনের। শনাক্তের হার ৪.২০ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এর চেয়ে বেশি রোগী একদিনে শনাক্ত হয়েছিল সর্বশেষ গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্ব^র। ওইদিন ১১৭৮ জনের মধ্যে সংক্রমণ শনাক্তের খবর এসেছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে আমাদের সময়ের রাজশাহী ব্যুরোর তথ্য বলছে, এ ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ওই হাসপাতালে উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ৩ জন। রামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমিত হয়ে ও উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে দুজন পুরুষ এবং দুজন নারী।
গতকাল শনাক্তদের নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮০৭ জনে। মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৯০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সেরে উঠেছেন ২১২ জন। সব মিলে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫০ হাজার ১৬৮ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।
মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ৭৭৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়ার তথ্য এসেছিল, মৃত্যু হয়েছিল ৬ জনের। সেই হিসাবে তার পরের ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী বেড়েছে ১১৭ জন। ওই দিন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৩.৯১ শতাংশ। গত একদিনে শনাক্ত নতুন রোগীদের মধ্যে ৭৩৯ জনই ঢাকা বিভাগের, যা মোট আক্রান্তের ৮২ শতাংশের বেশি। তবে এদিন দেশের ২৯টি জেলায় কারও সংক্রমণ শনাক্ত হয়নি। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা নেওয়া হয়েছে ২১ হাজার ৩০২টি। পরীক্ষা হয়েছে ২১ হাজার ২৫১টি। দেশে এখন পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১৩.৭১ শতাংশ। সুস্থতার হার ৯৭.৫৭ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১.৭৭ শতাংশ।
সংক্রমণের এ প্রবণতাকে আশঙ্কাজনক উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, এখন থেকে দেশের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। মাস্ক ছাড়া কেউ যানবাহনে চলাচল করতে পারবে না। মাস্ক ছাড়া কেউ চলাচল করলে জরিমানা হবে। গণপরিবহন অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। তিনি আরও বলেন, দেশে সপ্তাহখানেক ধরে রোগী বাড়তে শুরু করেছে। সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তা আশঙ্কাজনক। এখন থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকবে। দোকানে মাস্ক ছাড়া কেউ যেতে পারবে না, গেলে দোকান মালিক এবং ক্রেতা সবার জরিমানা করা হবে। বর্ডারগুলোকে আরও শক্তিশালী করা হবে। সারাদেশে মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মানে, সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের বর্ডারগুলোতে স্কিনিং আরও জোরদার করা হয়েছে। কোয়ারেন্টিনে যারা থাকবেন, তারা যাতে বাইরে ঘোরাফেরা না করে সে জন্য সেখানে পুলিশি প্রহরা থাকবে।
ওমিক্রন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ইতিপূর্বে আমরা ২৩ দফা প্রস্তাবনা দেই। সেই ২৩ দফা পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও গত নভেম্বরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যে প্রস্তাব দেওয়া হয় মন্ত্রণালয় সেটি বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছে। তবে রোগটি ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসা সংক্রান্ত সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। হাসপাতালগুলো প্রস্তুত আছে। ৪০টি হাসপাতালে অক্সিজেন জেনারেটর বসানোর কাজ চলছে। সব জেলা হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপনও শেষের দিকে। দেশে গত ২৮ ডিসেম্ব^র করোনা প্রতিরোধে বুস্টার ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে। বর্তমানে ৬০ বছরের বেশি বয়সী এবং সম্মুখসারির ব্যক্তিরা বুস্টার ডোজ পাচ্ছেন। পর্যায়ক্রমে বুস্টার ডোজ গ্রহণের বয়সসীমা কমিয়ে আনা হবে। বুস্টার ডোজ পাওয়ার জন্য টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ছয় মাস পূর্ণ হওয়ায় বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যাদের কো-মরবিডিটি আছে, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে আছেন তারা বুস্টার ডোজ নিতে পারবেন।
এদিকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে গতকাল দুপুরে ভারত থেকে সঞ্জীবন চন্দ্র বর্মণ নামে করোনা আক্রান্ত এক যুবক দেশে ফিরেছেন। তাকে জেলা সদর হাসপাতালে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে। সঞ্জীবনের বাড়ি রংপুরের জগদীশপুরে। স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন ইনচার্জ আবদুল হামিদ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ওই যুবকের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাগজ যাচাই করে কোভিড আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। ওই যুবক গত বছরের অক্টোবর মাসে ভারতে যান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন মো. একরামুল্লাহ জানান, ভারত ফেরত ওই যুবক ওমিক্রনে আক্রান্ত কিনা সেটা পরীক্ষা করা হবে।